আয়মান বারান্দায় দাঁড়িয়ে শীতের হাওয়া অনুভব করছিল। ঠিক সামনেই অন্য বাসার বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মধ্য বয়স্ক একজন লোক। পরিস্কার করে দাড়ি-মোচ কামানো। গালে লম্বা একটা কাটা দাগ আছে। চুল রঙ করা, গাঢ় বাদামী রঙ। উনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন এবং আশ্চর্যের বিষয় কোন রকম নড়াচড়া না করে সোজা আয়মানের দিকেই তাকিয়ে আছেন। হঠাত জিজ্ঞেস করলেন,
“ তোমরা এ বাসায় নতুন উঠেছো?”
আয়মান বলল, জ্বি।
“আমার নাম আবরার।“
জ্বি, আমার নাম………
“বলতে হবে না। আমি জানি তোমার নাম আয়মান।“
আয়মান চমকাতে গিয়েও চমকে উঠলো না। কিছুক্ষণ আগেই সে স্কুল থেকে ফিরেছে। ইউনিফরম, আইডি কার্ড কিছুই খুলে রাখে নি। নতুন বাসায় নিজের রুমের সাথে লাগানো বারান্দা টা তাঁর ভীষণ প্রিয়। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে সে কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ায়। তাঁর খুব ভাল লাগে।
আবরার নামক লোকটি বলল,
“কি ব্যাপার তোমার নাম বলে দিলাম তবু অবাক হলে না?”
আয়মান বলল, জ্বি না। আমি অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। আমার আইডি কার্ড দেখেই নাম টা বলেছেন।
“বাহ! তোমার তো অনেক বুদ্ধি!”
জ্বি, কিন্তু আপনি কেন আপনার নাম টা বানিয়ে বললেন?
“ আরে বাহ! এটাও ধরে ফেলেছো? তোমার নাম টা দেখেই কেন যেন আয়মানের সাথে মিলিয়ে আবরার নাম টা মাথায় খেলে গেল। তাই আর কি……
আর ঠিক এ কারণ টা বুঝতে পেরেই আমার ও মনে হলো আপনি আপনার নাম টা বানিয়ে বলেছেন।
“হা…হা…হা… তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার সাথে কথা বলে ভাল লাগলো আয়মান। আবার দেখা হবে। ভাল থেকো।“
আপনার সত্যি নাম টা আংকেল?
“আলিফ হোসেন”
ওকে আংকেল, আপনিও ভাল থাকবেন।
আলিফ হোসেন ঘরে চলে এলেন। এই জগতে এখন আর তার থাকতে ইচ্ছে করছে না। তিনি তাঁর ইজি চেয়ার টায় আধ শোয়া হয়ে চোখ বুজলেন। এটা তাঁর অন্য জগতে যাওয়ার প্রস্তুতি। তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন তাঁর ঘর টি অন্ধকার। তিনি বিছানায় বসে আছেন। অন্ধকার চোখে সয়ে এলে জানালা দিয়ে আসা আবছা আলোয় তিনি দেখতে পেলেন ঘরের কোনায় রাখা কয়েল টা নিভে গেছে। মশার কামড়েই সম্ভবত তাঁর ঘুম ভেংগেছে। অথচ আগের জগতের সময় টা ছিল শীতের এক সুন্দর বিকেল। তিনি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। এখন গভীর রাত। আশেপাশের প্রায় সব বিল্ডিং এর আলোই নিভে গেছে। তিনি দেখলেন সামনের বাসার ছেলে টা এখনো পড়ছে। তিনি ডাকলেন,
“আয়মান, আয়মান…”
ছেলে টা খুবই অবাক হয়ে এবং খুব সম্ভবত ভয় পেয়েই বারান্দায় বেরিয়ে এলো।
“জ্বি আমাকে ডাকছেন? আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?”
“কেন তোমার আইডি কার্ড দেখে!”
“কি বলছেন আমার আইডি কার্ড আপনি কোথায় দেখতে পেলেন?”
“ আচ্ছা আচ্ছা বাদ দাও। আমার নাম রহমত। তোমরা এ বাসায় নতুন এসেছো?”
“ এই তো কিছুদিন।“
“আগের জগতে তো ঠিকই ধরে ফেললে আমি বানিয়ে বানিয়ে নাম বলেছি, এখন যে একটা নতুন নাম বললাম অবাক হলে না?”
“ আগের জগত? কি যে বলেন, জগত তো একটাই।“
“না রে বোকা ছেলে। জগতের কি শেষ আছে। শুধু সুবিধা মতো এক একটা জগতে ঢুকে যেতে হয়।“
“এত রাতে আমাকে ডেকে কি সব উদ্ভট কথা বার্তা বলছেন। যান, ঘরে গিয়ে ঘুমান, আমার অনেক পড়া আছে।“
আলিফ সাহেব বুঝলেন তাঁর আগের জগতের আয়মান যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিল। আর এ জগতের আয়মান বোকা এবং অভদ্র। তাই তিনি ঠিক করলেন বুদ্ধিমান আয়মানের সাথেই কিছুক্ষণ গল্প করবেন। ঘরে ঢুকে তিনি তাঁর ইজি চেয়ার টায় শুয়ে চোখ বুজলেন এবং আগের জগতে ফিরে চললেন।
বারান্দায় গিয়ে আলিফ হোসেন দেখলেন আয়মান এখনো দাঁড়িয়ে।
“কি ব্যাপার তুমি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো! কেমন আছো তুমি? তুমি কিন্তু খুব বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু ঐ জগতের আয়মান খুব বোকা। ভাল করে কথা বলতেও জানে না।“
আয়মান একটু অবাক হলো। সে তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বেশীক্ষণ হয়নি। আংকেল কেন ভেতরে গিয়ে আবার ফিরে এসেই বলছেন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো! সে কিছুক্ষণ ভাবলো, আংকেল টার কি মাথা খারাপ? নয়তো এ জগত, ওই জগত কি সব বলছেন ? আরও কিছু জানার আগ্রহে তাই সে বললো,
“হুম, ঐ জগতের আয়মান সত্যি বোকা, তাই না?”
“হ্যা, তুমি কি জানো এ দুনিয়ায় কত ধরনের জগত আছে?”
“এই তো দুই ধরনের।“
“হলো না। এখানে জগতের শেষ নেই। কত্ত ধরনের যে অধ্যায়। শুধু পছন্দ মতো একটা তে ঢুকে যাও। “
“তাই নাকি আংকেল!”
“সব মানুষের এই ক্ষমতা থাকে না। তবে খুব বুদ্ধিমান রা এটা আয়ত্বে আনতে পারে। আমি ইচ্ছে করলেই এক জগত থেকে অন্য জগতে নিমিষেই চলে যেতে পারি।“
“আমি কিন্তু তা বুঝতে পেরেছি।“
“তুমি তো বুঝতে পারবেই। তুমি খুবই বুদ্ধিমান। শুধু চোখ বন্ধ করেই ইচ্ছেমত জগতে চলে যাওয়া যায়। একদিন বাসায় এসো, আমি শিখিয়ে দিব।“
আয়মান দেখলো আলিফ সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, এই পৃথিবী, এই জগত তো একটাই। কিন্তু সত্যি যদি অনেক গুলো জগত থাকতো! আর ইচ্ছে হলেই পছন্দমত জগতে চলে যাওয়া যেত!
কিছুদিন পর আয়মান বারান্দায় বসে তাঁর পোষা বিড়াল টাকে নিয়ে খেলছিল। এই প্রথম বার সে আলিফ সাহেবের বারান্দায় একজন মেয়ে কে দেখতে পেল। এ কয়দিন পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আংকেলের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। আয়মান বললো,
“আপনি কি আলিফ আংকেলের মেয়ে?”
“তুমি বাবাকে চেন?”
“জ্বি, আমি আয়মান। আপনার নাম?”
“আমি ইরানা।“
“আংকেল কোথায়? দেখি না যে… কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“বাবাকে নিয়ে কিছু?”
“জ্বি, কিছু মনে করবেন না।“
“কোন সমস্যা নেই। বাবার একটা অসুখ আছে। আশেপাশের সবাই যারা পরিচিত বাবার অসুখের কথা জানে। তোমরা নতুন এসেছো তো তাই হয়তো অবাক হয়েছো। “
“না না কিছু মনে করবেন না। একদিন যাবো আংকেলের সাথে দেখা করতে।“
“অবশ্যই আসবে, বাবা ও খুশী হবে।“
আয়মানের খুব কৌতুহল হচ্ছিল। এটা কেমন অসুখ, কেন হয় তাঁর খুব জানতে ইচ্ছে করছিল। হঠাত তাঁর মনে পড়লো সাইফুল আংকেলের কথা। তাঁর বাবার বন্ধু সাইফুল আংকেল একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। তাঁর থেকেই তো সে এ ব্যাপারে জানতে পারবে। আয়মান বাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অফিস থেকে ফিরলেই বাবাকে সাথে নিয়ে সে চললো সাইফুল আংকেলের কাছে। যেতে যেতে তাঁর হঠাত ই মনে হলো, আচ্ছা সে কি এখন আসল জগতেই আছে,না এ জগত অন্য জগত!
ডাঃ সাইফুল খুবই আন্তরিক মানুষ। আয়মান কে তিনি খুব পছন্দ করেন। আয়মানের কাছ থেকে খুটিয়ে খুটিয়ে আলিফ সাহেব সম্পর্কে সব শুনলেন। এবার তিনি আয়মান কে বুঝিয়ে বললেন,
এটি একটি মানসিক রোগ। অতিরিক্ত মানসিক চাপে এরকম হয়। কোন একজন মানুষের যখন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী হয় যার চাপ সে আর মানসিকভাবে নিতে পারে না, এর থেকে সে পালাতে চায়। তাঁর জগত টাই উলটে পাল্টে যায়। সে মুক্তি চায়। প্রচন্ড মানসিক চাপে সে আরেক টি জগত কল্পনা করতে থাকে। তাঁর কল্পিত জগতে চেনা জানা মানুষগুলোই ঘুরে ফিরে আসে। এই কল্পিত জগতে যখন আবার কোন অপছন্দের পরিস্থিতি তৈরী হয় , তার থেকে মুক্তি খোঁজে আরেক জগত কল্পনা করে। আর এভাবেই সে এক জগত থেকে অন্য জগতে বিচরণ করে। আর আসল জগত থেকে সারা জীবনের জন্য মুক্তি খুঁজে নেয়। সত্য আর কল্পনার পৃথিবী এক সাথে চলতে থাকে। এ সমস্যার সমাধান কি, আয়মান জিজ্ঞেস করে।
কোন সমাধান নেই। কারন রোগী নিজে এর সমাধান চায় না। তাই সারা জীবন সে এভাবেই কাটিয়ে দেয়। শুনে আয়মানের খুব মন খারাপ হয়।
বাসায় ফিরেই আয়মান বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে আলিফ সাহেব বারান্দায় বসে কেমন অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছেন, যেন তিনি তাকিয়েই আছেন আসলে কিছুই দেখছেন না। আশে পাশে কি ঘটছে কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না। আয়মান ডাকলো,
“কেমন আছেন আংকেল?”
“ভাল।“
“আপনার জগত ভ্রমন কেমন চলছে?”
‘খুবই ভাল।“
“আপনি কি এই ভিন্ন ভিন্ন জগত না ঘুরে থাকতে পারবেন?”
“অসম্ভব। এরকম সৌভাগ্য কয়জনের হয়! তুমি একটা কথা শুনবে?”
“অবশ্যই আংকেল, বলুন।“
“ ভেতরে যাও। গিয়ে তোমার বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করো। ভাবো, ভাবো তোমার যা ভাবতে ভাল লাগে।“
“এরকম করলেও আমি অন্য জগতে যেতে পারবো না আংকেল। আমার সেই ক্ষমতাই নেই, তাছাড়া আমি তো যেতেও চাই না।“
“পারবে। তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। তুমি অবশ্যই জগতের পর জগত ঘুরে বেড়াতে পারবে।“
আয়মান হাসলো,আর কথা না বাড়িয়ে সে ভেতরে চলে এলো। নিজের অজান্তেই আলিফ সাহেবের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ পর আয়মান চোখ মেলে তাকালো। দেখলো, বাইরে এখন ভোর। সে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। নীল আকাশ টা আস্তে আস্তে ফরসা হচ্ছে। তাঁর শীত শীত লাগছে। কত রকমের পাখীরা ডাকছে। আশ্চর্য এরকম একটা ভোর দেখার ইচ্ছা তাঁর কত্ত দিনের! কিন্তু একটু আগেও তো সন্ধ্যা ছিল! সাইফুল আংকেলের কাছ থেকে তারা বাসায় ফিরলো। এখনি ভোর হলো কি করে? সে কি অন্য জগতে এসে পরেছে? কিন্তু তার তো কোন মানসিক চাপ ও নেই। তাহলে? কি হচ্ছে এসব? আয়মান জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগলো, “আংকেল, আংকেল”
এই ভোরবেলা আয়মানের চিৎকারে আলিফ সাহেব ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন।
“কি ব্যাপার আয়মান?তুমি এতো ভোরে? ডাকছো কেনো?”
“আপনি যে সব সময় বলেন অন্য জগতের কথা,ইচ্ছে হলেই যাওয়া যায়। অন্য জগত আছে, আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।“
“কি বললে, অন্য জগত? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? অন্য জগত আবার কি? এই পৃথিবী, এই জগত একটাই। “
আয়মান ভেতরে চলে এলো। বোকার মতো বসে রইলো। সে কি সত্যি পাগল হয়ে গেলো? কিছুই বুঝতে পারছে না।
Date : 12-October-2016