নভোচন্দ্রের ভূবন

– একটি কল্প কাহিনী

novochandrer-bhubon-background

তৌকির সাহেব রাস্তায় হেটে হেটে বাড়ীর দিকে যাচ্ছেন। তাঁর হাতে দুই হালি কলা। কলা তাঁর প্রিয় ফল। তিনি প্রত্যেক দিন কম করে হলেও তিনটি কলা খান। না খেলে কেমন যেন অস্বস্তিবোধ করেন। পানি না খেলেও কলা তাকে খেতে হবেই।

হাটতে হাটতে এক সময় তিনি তাঁর হাতের দিকে তাকালেন, একি! তাঁর হাতে ছয়টি কলা কেন? তিনি নিজে হিসাব করে দুই হালি মানে আটটি কলা কিনেছেন এখন দুটি কলা উধাও হলো কি করে? ছিঁড়ে রাস্তায় পরে গেলেও তো তিনি বুঝতে পারতেন! একটি সাধারণ বিষয়, কলা ছিঁড়ে রাস্তায় পরে যেতেই পারে, হয়তো কোন কারনে তিনি টের পান নি, তবু তৌকির সাহেব অস্থির বোধ করলেন। বাড়ীতে ফিরেই তিনি স্ত্রীকে বললেন, শরীর টা ভাল লাগছে না, আজ এখনই শুয়ে পরবো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি আজ কলা না খেয়েই শুয়ে পরলেন। বিরাট চিন্তার বিষয়!

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। মাঝ রাতে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। পাশে তাঁর স্ত্রী ঘুমুচ্ছেন। হঠাত একটা শব্দ শুনতে পেলেন,

“তৌকির সাহেব, ও তৌকির সাহেব! আপনার কলা খাওয়াতে কি রাগ করেছেন?”

মানে কি? কে কথা বলে? প্রচণ্ড ভয়ে তৌকির সাহেবের সারা শরীর কেঁপে উঠলো। স্ত্রীকে যে ডেকে তুলবেন সে সাহসও তাঁর হলো না। কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলেন,

“কে কথা বলে? কে ওখানে?” বলার সাথে সাথে আলমারির দিকে বেশ বড় একটা ছায়াও তিনি দেখতে পেলেন।

“আহা! আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না?” এমন একটি কন্ঠ শোনা গেল যে কন্ঠ মানুষের হতে পারে না।

“কে আপনি? কি চান?” তৌকির সাহেবের ভয় আরো বেড়ে গেল, প্রচন্ড ভয়ে এই বুঝি তিনি অজ্ঞান যাবেন।

“আমি নভোচন্দ্র। আপনি আমাকে ভুলে গেলেন কি করে? এত ভয় পাচ্ছেন কেন স্যার! আর দয়া করে আপনি আমাকে তুই করে বলবেন।“

তৌকির সাহেব খুব কষ্টে স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুললেন। তাঁর স্ত্রী রাহীমা ঘুমন্ত চোখে বললেন,

“এত রাতে কি হয়েছে? ডাকছো কেন?”

“আরে! আমাদের বাসায় ভুত এসেছে,ভুত!”

“তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? স্বপ্ন দেখেছো?”

“তোমার বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে দেখ, ওই যে…”

রাহীমা খাতুন খুব অনিচ্ছার সঙ্গে তাকালেন ঘরের কোনাটার দিকে, আর তাকানোর সাথে সাথে তাঁর চোখের সকল ঘুম নিমিষেই উধাও হলো। ঐ তো একটা বিরাট ছায়া !

“কি ওটা, কি ওখানে?” বলে উঠলেন তিনি। চোখ আছে কি নেই বোঝার উপায় নেই, তবু তাঁরা দুজনই বুঝতে পারলেন আর কারো দিকে নয়, ছায়াটা  তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।

হঠাত ছায়াটি বলে উঠলো, “আমায় ভয় পাবেন না। আমি এক অতি সাধারণ লোক।“ জোর করে সাহস জাগিয়ে তৌকির সাহেব বললেন,

“ব্যাটা তুই যদি লোকই হয়ে থাকবি তো ভুত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন?”

“কি বললেন আমি ভুত? জ্বী না, আমি ভুত জ্বীন কিছু না। তবে আমি যে কি তা আমি নিজেই জানি না।“

তৌকির সাহেব তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন, ওমা ! সে তো নাক ডেকে আরাম করে ঘুমুচ্ছে! তিনি আবার তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন। রাহীমা ছোট করে চোখ খুলে বললেন,

“ডাকছো কেন শুধু শধু?”

“ডাকছি মানে! ঘরের ভেতর এরকম একটা ভুত দেখেও কি করে তুমি ঘুমাতে পারছো?”

“কি বলছো এই সব? এত রাতে এরকম পাগলামি করছো কেন বল তো?”

“পাগলামি? ওই দেখো … “

রাহীমা পুরো ঘর দেখে গর্জন করে বলে উঠলেন, “ অই দিকে কেন, কোন দিকেই কিছু নেই। শুধু শুধু বিরক্ত করবে না।“ এই বলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পরলেন।

তৌকির সাহেব নিজেও ভাল করে ঘরটি দেখলেন, আসলেও কিছুই নেই। এতক্ষণ তাহলে তিনি কি দেখেছেন? কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তিনিও শুয়ে পরলেন ঘুমানোর জন্য। ঘুম তো এলই না , ঘড়ির টিকটিক শব্দে রাত কেটে গেল ধীরে ধীরে।

দুদিন কেটে গেছে। এই দুদিনে কাজের চাপে তৌকির সাহেব সেদিনের রাতের ঘটনা টা প্রায় ভুলেই গেছেন। তিনি আবার সাধারণ মানুষ হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন কলা কিনছেন, খাচ্ছেন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন, অফিস করছেন, সবই তো স্বাভাবিক।

একদিন রাতে, তিনি অফিস শেষে বাসায় ফিরেছেন। তাঁর স্ত্রী রাহীমা বাবার বাড়ী বেড়াতে গিয়েছেন। বাসায় তিনি একা। একা থাকা ব্যাপার টি তিনি খুব ইনজয় করেন । কেমন একটা স্বাধীনতার স্বাদ পান, মুশকিল হয় শুধু একটা বিষয় নিয়ে। তিনি বেশীক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারেন না। সারাদিন কোথায় কি করেছেন কাউকে না কাউকে তাঁর বলতে হয়ই। হাত মুখ ধুয়ে ড্রইং রুমে গিয়ে বসলেন তিনি, খাবার রেডি করে টেবিলে রেখেছেন, একটু পর খাবেন। তৌকির সাহেব টিভি ছাড়লেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফী তে তাঁর প্রিয় অনুষ্ঠান দেখাচ্ছে। একটা লোক কাঁচা মাংস খাচ্ছে, খানিকটা কৌতুহল এবং আতঙ্ক নিয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন।

একটু পর তিনি শুনলেন, কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে। বাড়ীতে কলিং বেল থাকা স্বত্তেও কেউ দরজায় টোকা দিবে কেন? তৌকির সাহেব বিরক্ত হলেন। বিরক্ত হলেন কারন পরিচিত কেউ হলে অবশ্যই বেল বাজাতো, যিনি এসেছেন তিনি অপরিচিত বলেই টোকা দিচ্ছেন। প্রিয় অনুষ্ঠান ছেড়ে অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে এখন তাঁর ইচ্ছে করছে না।

তৌকির সাহেব দরজা খুললেন, দেখলেন একজন ভীষণ লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় চুল, বড় ফ্রেমের চশমা আর দাঁড়ি গোফে তার চেহারা প্রায় ঢেকে গিয়েছে, সে বলল, “স্যার আসবো?”

তৌকির সাহেবের কাছে লোকটিকে চেনা মনে হলো কিন্তু তিনি ধরতে পারলেন না। বললেন, “আসুন।“

লোকটি ভেতরে ঢুকে সোফায় বসতে বসতে বলল, “স্যার বোধ হয় আমাকে চিনতে পারছেন না।“

“জ্বী না, চিনতে পারি নি। কে আপনি?”

“স্যার আমি নভোচন্দ্র। আমায় ভুলে গেলেন স্যার!”

তৌকির সাহেব আচমকা প্রচন্ড ভয় পেলেন। তাঁর হাত পা শক্ত হয়ে এল। হঠাত তাঁর সেদিনের রাতের কথা মনে পরে গেল। যতই দিন যাচ্ছে তিনি কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছেন!

যাই হোক, তিনি মনে মনে সাহস সঞ্চার করলেন। এর আগে এই লোক ছায়াভুত ছিল, এবার মানুষ রূপেই এসেছে। এমনিতে বাসায় কেউ নেই যে তিনি কথা বলতে পারবেন, বরং এখন এই লোকের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করলে সময় টা ভালই কাটবে।এতে করে হয়তো তাঁর ভয় টা কেটে যাবে আর এই লোকের আসল ব্যাপারটাও জানা যাবে। তৌকির সাহেব বললেন, “ভাই আপনি কি আসলেই মানুষ না আমার কল্পনা?”

নভোচন্দ্র বলল, “স্যার আমি ঠিক জানি না।“

“আপনার নাম টা কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কারন টা জানতে চান?”

“অবশ্যই স্যার।“

“এই দুনিয়ায় আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস দুটো, আকাশ এবং চাঁদ। সীমাহীন আকাশের মাঝে এক উজ্জ্বল চাঁদ দেখতে আমার খুব ভাল লাগে।“

“বাহ! আমার নাম টা তো তাহলে আপনার প্রিয় বিষয় গুলোর সাথে মিলে গেল। নভো শব্দের অর্থ হলো আকাশ আর চন্দ্র মানে চাঁদ।“

“আরে এ জন্যই তো আপনার নাম টা আমার পছন্দ হয়েছে। চা খাবেন?”

“জ্বী স্যার খাবো।“

তৌকির সাহেব খুব যত্ন করে সময় নিয়ে চা বানালেন। তিনি বার বার নিজেকে বোঝাতে লাগলেন, এ সবই তাঁর মস্তিস্কের কল্পনা। বাসায় তিনি একা আছেন। কথা বলার জন্যই তিনি এসব কল্পনা করে নিচ্ছেন। ড্রইং রুমে গিয়ে তিনি দেখবেন সেখানে আসলে কেউ নেই।

তৌকির সাহেব চা খেতে খেতে বললেন, “ নভোচন্দ্র আপনি আসলে আমার কল্পনা নন, কল্পনা হলে আপনি চায়ের কাপ উঠিয়ে তাতে চুমুক দিতেন না।“

“আমারও তা মনে হয় স্যার।“

“চলুন ছাদে যাই। ছাদে গিয়ে আমরা গল্প করি।“

“চলুন স্যার।“

তৌকির সাহেব নভোচন্দ্রকে নিয়ে ছাদে গেলেন। অপূর্ব গোলাকার চাঁদের সঙ্গে রাতের আকাশ। সাথে কিছু মেঘ ও দেখা যাচ্ছে। তিনি বললেন,

“নভোচন্দ্র সাহেব, আমি কিন্তু মেঘোচন্দ্রকেও দেখতে পাচ্ছি!”

“মেঘোচন্দ্র মানে?”

“মেঘ আর চন্দ্র! আমার ইচ্ছ করছে কি জানেন? আমার ইচ্ছা করছে এখনই উড়ে চলে যাই ঐ চাঁদ আর আকাশের মাঝে। অসীম রহস্য ঐ আকাশের! কতকি জানার আছে।“

“তা কিন্তু সম্ভব, স্যার।“

“মানে কি? কিভাবে? কিসব যে বলেন?!”

“আপনি চাইলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আপনাকে শুধু ভাবতে হবে, চিন্তা করতে হবে আপনি উড়ে যাচ্ছেন। দেখবেন আপনি সত্যিই উড়ে চলে যাচ্ছেন আকাশে।“

তৌকির সাহেব কল্পনা করতে শুরু করলেন। তিনি অনুভব করতে চেষ্টা করলেন যে তিনি আকাশে উড়ে যাচ্ছেন আর আশ্চর্যের ব্যাপার তার পা শূন্যে ভেসে উঠল। আস্তে আস্তে তিনি উপরে উঠতে শুরু করলেন। এইতো! এইতো তিনি আকাশে উঠে পড়েছেন। তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ধন্যবাদ, নভোচন্দ্র।“

নভোচন্দ্র কিছু বলল না, শুধু হাসল। সে দেখল, তৌকির সাহেব মেঘের মাঝে হারিয়ে যেতে শুরু করেছেন। খানিকক্ষন পর তৌকির সাহেব বিন্দুর মত হয়ে শূন্যে মিলিয়ে গেলেন।

-০-

One thought on “নভোচন্দ্রের ভূবন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *